মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জোগানো কালজয়ী গান ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি...’। কালজয়ী এ গানের সুরকার ও গায়ক আপেল মাহমুদ। সবার কাছে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত তিনি। তবে, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর একুশে পদকজয়ী এ শিল্পীকে নতুন করে প্রমাণ দিতে হলো তিনি মুক্তিযোদ্ধা।
সম্প্রতি আপেল মাহমুদের মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় নিয়ে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) অভিযোগ করেন এক ব্যক্তি। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে সোমবার বিকালে কুমিল্লা সার্কিট হাউসে জামুকার শুনানিতে হাজির হন তিনি। প্রমাণ দেন, তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগানোর পাশাপাশি পাক সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে লড়াই করা আপেল মাহমুদ কুমিল্লার জেলার মেঘনা উপজেলার বাসিন্দা।
জামুকা সুত্র থেকে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর স্বাধীন বাংলা বেতারকর্মী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন আপেল মাহমুদের বিরুদ্ধে জামুকায় অভিযোগ করেন। অভিযোগে আপেল মুক্তিযোদ্ধা নন বলে দাবি করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে গত ১২ মে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের উপপরিচালক (উন্নয়ন) ফাতেমা খাতুন আপেল মাহমুদকে নোটিশ করেন। সেই নোটিশে তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা, এর পক্ষে যাবতীয় দলিল ও সাক্ষ্য উপস্থাপনের জন্য বলা হয়।
সোমবার বিষয়টি নিয়ে কুমিল্লা সার্কিট হাউসে শুনানি হয়। শুনানিতে জামুকার মহাপরিচালক শাহিনা খাতুনসহ সাত সদস্যদের প্রতিনিধিদল উপস্থিত ছিলেন। এদিন জেলার বিভিন্ন উপজেলার বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগেরও শুনানি করা হয়।
জামুকার মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন বলেন, ‘আপেল মাহমুদ যথাযথভাবে প্রমাণ করেছেন তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি যদি শুধু গান গেয়ে উদ্বুদ্ধ করার মতো ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকতেন তাহলে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খেতাব পেতেন। কিন্তু, কাগজপত্রে প্রমাণ করেছেন তিনি অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হয়েছি।’
জামুকার এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘৫ আগস্টের পর কুমিল্লা জেলা থেকে ৩১ মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। সেসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে কুমিল্লা সার্কিট হাউসে দুটি কমিটিতে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে।’
আপেল মাহমুদ বলেন, ‘জীবিত থেকেই দ্বিতীয়বার প্রমাণ করতে হয়েছে আমি মুক্তিযোদ্ধা। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সদস্যরা দুঃখ প্রকাশ করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের কমান্ডে আমি তিন নম্বর সেক্টরে সরাসরি যুদ্ধ করেছি। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত আমরা নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেছি। নরসিংদী থেকে আমরা চলে যায় ক্যাপ্টেন নাসিমের আন্ডারে আশুগঞ্জে। সেখানে আমরা ভৈরব রামনগর ব্রিজে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করি। সেখান থেকে রামনগর ব্রিজ, ভৈরব, আশুগঞ্জ, হবিগঞ্জ, চুনারুঘাট, চানপুর টি স্টেট, তেলিয়াপাড়া টি স্টেটে যুদ্ধ করেছি। তেলিয়াপাড়া ১৯৭১ সালে আমার শেষ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। আশুগঞ্জের যুদ্ধের সময় আমার বাঁ চোখের পাশে আঘাত লাগে।’
আপেল মাহমুদ বলেন, ‘সেখান থেকে আমাকে আগরতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আবদুল জব্বার ভাইও আসেন। ২৫ মে কলকাতায় বড় করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতেই আমাকে ও জব্বার ভাইকে শরণার্থীদের জন্য একটি অনুষ্ঠান করতে হয়েছে। আমরা দুদিন অনুষ্ঠান করে অনেক শিল্পী পাই। ১ জুন থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমার ওপর যে দায়িত্ব ছিল তা ২০০৬ সালে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত পালন করেছি।’
অভিযোগ দাতার বিষয়ে এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আমি তো মনোয়ার হোসেনের কোনো ক্ষতি করিনি। জানি না তিনি কেন এমন করলেন। তার ভিত্তিহীন অভিযোগের কারণে বেঁচে থাকা অবস্থায় আমাকে প্রমাণ করতে হয়েছে যে আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।’
কুমিল্লা সার্কিট হাউসে আপেল মাহমুদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তার সহধর্মিণী নাসরিন মাহমুদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক মনোরঞ্জন ঘোষাল, বাংলাদেশ বেতারের সাবেক পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফুল আলম, বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর হায়াত খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ সাহাসহ কয়েকজন।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, ‘পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছেন জামুকার সদস্যরা। আমরা শুধু শুনানির স্থানটি নির্ধারণ করে দিয়েছি। ঢাকা থেকে আসা জামুকার মহাপরিচালকসহ প্রতিনিধিদল শুনানি পরিচালনা করেছে।’
উল্লেখ্য, আপেল মাহমুদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ গানের গায়ক হিসেবে পরিচিত হলেও তার বেশ কিছু গান আজও মানুষের হৃদয়ে রয়েছে। ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে... ’ গানটিও তার একটি বিখ্যাত গান। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি ২০০৫ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হন। দেশাত্মবোধক গান ছাড়াও রবীন্দ্রসংগীত, লালনগীতি, গণসঙ্গীত ও আধুনিক ধারার গান গেয়ে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন আপেল মাহমুদ।