ডয়েচে ভেলের মুখ মুখি সদ্য বিদায়ী জেনারেল আজিজ
মোঃ শাহিদুন আলম
December 29, 2021
বাংলাদেশ-ইজরায়েল। নেই কোনো রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বা বাণিজ্যিক সম্পর্ক। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতি শুরু থেকেই অত্যন্ত বিরাগভাজন। বাংলাদেশ স্বাধীনের পরপরই বঙ্গবন্ধু যে রাষ্ট্রের বন্ধুত্বের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, সেই ইজরায়েলের PICSIX P6 Intercept স্পাইওয়ার কেন বাংলাদেশে? সেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের জনসাধারণের মাঝে। সকলের মনে প্রশ্ন জাগে, জনগণের মুঠোফোনে জেনারেল আজিজের নেতৃত্বে সরকারি কোনো সংস্থা কি আড়ি পাতছে?
স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের সময় থেকে এ পর্যন্ত এদেশের মাত্র ১৭ জন সূর্য-সন্তান সেনাপ্রধানের আসন অলংকৃত করেছেন। জেনারেল আজিজ আহমেদ সেই সৌভাগ্যবানদেরই একজন। যার অসীম দক্ষতা, অভিজ্ঞতাকে ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ২৫ জুন, ২০১৮ বাংলাদেশ সরকার ১৬ তম সেনাপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত করে। নিযুক্তির সময় থেকেই কিছু কিছু বিষয়ে যিনি সম্মুখীন হয়েছেন নানান বিতর্ক ও সমালোচনার, প্রশংসিতও হয়েছেন অনেক। গত ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০২১ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম 'আল-জাজিরা' জেনারেল আজিজ আহমেদ ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে 'All the prime minister's men' নামে একটি আলোচিত ইনভেস্টিগেটিভ ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে। ডকুমেন্টারিটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পক্ষে বিপক্ষে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সুদীর্ঘ ৯ মাস পর জেনারেল আজিজ আহমেদ গণমাধ্যমে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেন। গত ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ জার্মান ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম DW বাংলায় সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দিনের মুখোমুখি হন জেনারেল আজিজ আহমেদ। বিভিন্ন সময় তাঁর বিরুদ্ধে আনা বিভিন্ন অভিযোগ খন্ডাতে তিনি চেষ্টা করেন।
কিছু মহল শুরু থেকেই দাবী করে আসছে জেনারেল আজিজ আহমেদ সরকারের মদদ পুষ্টে রাজনৈতিকভাবে সেনাপ্রধান হয়েছেন এবং তারপর থেকে অন্যায়ভাবেই প্রচুর অর্থ বানিয়েছেন। আসলেই কি তাই? জেনারেল আজিজ চ্যালেঞ্জ করেছেন যে, তিনি ডিজি বিজিবি এবং সেনাপ্রধান থাকা কালে বিজিবি এবং সেনাবাহিনীর কোন অস্ত্র- গোলাবারূদ, স্বরন্জামাদী ক্রয় সংক্রান্ত কোন কন্ট্রাক্ট তার কোন ভাই বা আত্বীয়কে দেন নাই। তিনি এটাও বলেছেন যে তিনি এখন অবসরে, খোঁজ নিয়ে দেখুক কেউ যদি একটা প্রমানও দিতে পারে। যারা এই অভিযোগ করে আসছে তারা উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভিত্তিহীন ও সূত্রহীন অভিযোগ করছে।
জেনারেল আজিজ আহমেদ রাজনৈতিক মদদ পুষ্টে সেনাপ্রধান হননি, নিজের যোগ্যতার জন্যই সরকার তাকে সেনাপ্রধান নিয়োগ দিয়েছিলেন বলেও দৃঢ়তার সাথে দাবী করেছেন। এই প্রসংগে তিনি বলেন যে কমান্ড এক্সপ্রিয়েন্স, ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট অ্যাবিলিটি, সার্ভিস প্রোফাইল, বিভিন্ন সামরিক কোর্স এবং অন্যান্য পারফরমেন্সের ভিত্তিতেই একজন সেনা কর্মকর্তাকে সেনাপ্রধান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। তৎকালীন সময়ে সর্বমোট তিনজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যাদের মধ্যে থেকে যেকোনো একজনকে সেনাপ্রধান হিসেবে সরকার নিয়োগ দিতে পারতো। জেনারেল আজিজ আহমেদ ছিলেন তাঁদের একজন। যিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দুই লেফটেন্যান্ট জেনারেল থেকে কোনো অংশেই পিছিয়ে ছিলেন না, বরং কিছুক্ষেত্রে বিশেষ করে কমান্ড এক্সপ্রিয়েন্স, ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট অভিজ্ঞতার দিক থেকে তাঁদের থেকেও তিনি এগিয়ে ছিলেন। তিনি জানান, প্রথম সারির একজন হিসেবে তিনি তাঁর প্রায় সবগুলো সামরিক কোর্সই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। আর্টিলারী অফিসার হয়ে ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডেও যিনি ছিলেন ব্রিগেড মেজর। বিডিআর এবং সেনাবাহিনীতে দুইটি ইউনিট ছাড়াও তিনি দুইটি ব্রিগেড এবং একটি ডিভিশন কমান্ড করেছেন। এছাড়াও তিনি চার বছর বিজিবি প্রধান ছিলেন এবং চৌদ্দ মাস জিওসি আর্টডক ছিলেন। তিনি ডিজি বিজিবি থাকাকালীন সীমান্ত হত্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনতে তিনি সক্ষম হন। কাজেই সেনাপ্রধান হওয়ার জন্য তাঁর যোগ্যতায় কমতি ছিলো না। সার্বিক দিক বিবেচনায় বাকী দুই প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে সরকার জেনারেল আজিজ আহমেদকে অধিক যোগ্য মনে করায় সেনাপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত করেছিলো বলে তিনি দাবী করেন যেটিকে রাজনৈতিক বিবেচনা মনে করটা ভুল।
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬ জাতিসংঘ হেডকোয়ার্টারের Department of peacekeeping Operations বাংলাদেশ থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে জানতে চায়– তাদের একটি সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট দিতে পারবে কী না। মনুস্কো, কঙ্গোতে জাতিসংঘের পিস কিপিং মিশনের জন্য এই ইউনিটটি প্রয়োজন ছিলো। ৫ জানুয়ারি, ২০১৭ আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে জানানো হয় যে, সেপ্টেম্বর, ২০১৮ এর পর জাতিসংঘকে কাঙ্ক্ষিত ইউনিট প্রদান করতে পারবে । কারণ জাতিসংঘ হেডকোয়ার্টার থেকে চাওয়া প্রয়োজনীয় ইকুয়েপমেন্ট ছিলো না বাংলাদেশের কাছে। অর্থাৎ জাতিসংঘ থেকে চাওয়া সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের জন্য চাহিদাকৃত ইকুইপমেন্ট সেনাবাহিনীর ছিলো না। আর এটিই আল জাজিরায় প্রদর্শিত সেই ইজরায়েলি স্পাইওয়ার যা হাঙ্গেরি থেকে খরিদ করা হয়। ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর GSPC এই প্রকল্প অনুমোদন করে। অতঃপর ৪ জুন ২০১৮ আর্ম ফোর্সড ডিভিশন থেকে এই ঐ ইকুইপমেন্ট ক্রয়ের অনুমোদন করা হয়। ২৬ জুন, ২০১৮ DGDP তে কন্টাক্ট করা হয়, যা হাঙ্গেরির তৈরী এবং PIXSIX লিমিটেড এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় যার প্রিন্সিপাল ছিল হংকং বেইজ। সুতরাং হঠাৎ করেই নয় বরং ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬ থেকে ২৬ জুন, ২০১৮ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই স্পাইওয়ার ক্রয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। অথচ জেনারেল আজিজ আহমেদ সেনাপ্রধান হন তার মাত্র একদিন আগে ২৫ জুন, ২০১৮। জেনারেল আজিজ আহমেদ দাবী করেন এই প্রক্রিয়ার সাথে তিনি কোন ভাবেই সম্পৃক্ত ছিলেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ঐ ইকুইপমেন্ট ক্রয়ে দেরী হওয়ায় জাতিসংঘ তানজানীয়া থেকে সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট মনুস্কোতে মোতায়েন করে। আর ঐ ইকুইপমেন্টটা অকেজো অবস্থায় আছে।
২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী নির্বাচন কমিশনের সুস্পস্ট নির্দেশনার আলোকে দায়িত্ব পালন করেছে বলে দাবী করেন। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুসারে– রিটার্নিং অফিসার, ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যান্য নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যদি সেনা সহায়তার জন্য আবেদন করে তবেই সেনাবাহিনী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে। চাইলেই ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সেনাবাহিনীর যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ ছিলো না। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুসারে, কোনো সেনা বহর ভোটকেন্দ্র অতিক্রমের সময় নিজ থেকে থামতে পারবেনা। ভোটারদের নিরাপত্তা প্রদান ও নির্বাচনকে ঘিরে সুস্টু আইন শৃংখলা বজায় রাখতে সেনাবাহিনী অন্যান্য বাহিনীর সাথে কাজ করেছিলো। এর বাহিরে অন্য কোনো কর্মকাণ্ডের এখতিয়ার নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সেনাবাহিনীকে প্রদান করা হয়নি। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত সেনাবাহিনীর উপর অর্পিত দায়িত্বের সফলতার ভিত্তিতে ২০১৮ সালের নির্বাচনকে জেনারেল আজিজ আহমেদ অসাধারণ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
২০১৯ সালের এপ্রিলে সিঙ্গাপুরে একটি অফিসিয়াল প্রোগ্রাম শেষ করে ফিরে আসার সময় ৩৬ ঘণ্টার এক ট্রানজিটে মালোশিয়া যান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং স্বাভাবিকভাবেই বড় ভাইয়ের বাসায় ওঠেন তিনি। ২০০৭ সাল থেকে সেকেন্ড হোম হিসেবে তাঁর বড়ভাই বৈধভাবে মালোশিয়ায় বসবাস করে আসছেন। যেটাকে আল জাজিরার রিপোর্টে পলাতক ভাইদের সাথে দেখা করতে গিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। যদিও সে সময়ে জেনারেল আজিজ আহমেদের কোনো ভাইয়ের নামে কোন মামলা-মোকাদ্দমা ছিলো না। কাজেই আলজাজিরার প্রতিবেদনকে সর্বাংশে সত্য বলে গ্রহণ করছেন না জেনারেল আজিজ আহমেদ। তাঁর দুই ভাইয়ের ভিন্ন নামের পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়ায় অনেকে ভাল জীবিকার জন্য বিদেশ গমন করেছে।
বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যম গুলোতে প্রকাশিত, যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্তৃক সাবেক এই সেনাপ্রধানের ভিসা বাতিলের যে সংবাদ প্রচার করা হয়, যা ভিত্তিহীন বলে তিনি দাবী করেন। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের কোন কর্তৃপক্ষ থেকে এমন কোনো নোটিশ তিনি পাননি বলে অতিবাহিত করেন জেনারেল আজিজ আহমেদ। তাঁর ফোনালাপ ফাঁসের বিষয়ে তিনি বলেন, হাইটেকনোলজি ব্যবহার করে তার কথাপকথনকে বিকৃত করা হয়েছে। ২৫ জুন, ২০২২ সম্পূর্ণরূপে অবসরে যাওয়ার পর এই সকল বিষয়গুলুর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান DW বাংলায় সাক্ষাৎকারে।
প্রসঙ্গক্রমে এই বিষয়টি পরিস্কার করা দরকার
শহীদ দাবী করছিল যে জেনারেল আজিজ আহমেদ নাকি তাকে প্রথম ফোন করেছিল এবং সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিল। জেনারেল আজিজ আহমেদ তার এই বক্তব্যের চ্যালঞ্জ দিয়ে বলেন তাদের যেই বেসমেট এর মাধ্যমে শহীদ প্রথম জেনারেল আজিজ আহমেদকে কথা বলতে অনুরোধ করেছিল এবং তার সমস্যার একটি সমঝোতা করে দিতে অনুরোধ করেছিল জেনারেল আজিজ আহমেদকে অনুরোধ করেছিল তা যে কেউ চাইলে যাচাই করে দেখতে পারেন। জেনারেল আজিজ আহমেদ তারে সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়ার কোন প্রশ্নই আসেনি বলেও দাবী করেন।
Share This