যাদের হাতে দাওয়াত ও তাবলিগের সূচনা

যাদের হাতে দাওয়াত ও তাবলিগের সূচনা

নিজস্ব প্রতিবেদক January 04, 2022

বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার ও প্রসারে অসামান্য অবদান রাখছে তাবলিগ জামাত। শান্তিপূর্ণ উপায়ে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিচ্ছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। ইসলামের ছয়টি বিশেষ আমল সামনে রেখে কাজ করছে তারা।

তাবলিগের মাধ্যমে পৃথিবীতে হাজার হাজার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছে, ঈমান ও ইসলামের পথে আসছে লাখো মুসলিম। যুগান্তকরী এ দাওয়াতি কাজের সূচনা করেছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের সন্তান শায়খ ইলিয়াস রহ.। তারপর তার রুহানি সন্তানরা এগিয়ে নিয়ে গেছেন তার এ বরকতময় কাজকে। দাওয়াতি কাজে অসামান্য অবদান রেখেছেন এমন ৪ জন মুরব্বির নাম ও পরিচিতি তুলে ধরা হলো এখানে।

তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস রহ.
১৮৮৫-১৯৪৪

নাম ইলিয়াস। বাবা: তত্কালীন যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ও আবেদ মাওলানা ইসমাইল রহ.। মাওলানা ইলিয়াস রহ. ১৮৮৫ সাল মোতাবেক ১৩০৩ হিজরিতে ভারতবর্ষের উত্তর প্রদেশের মুযাফ্ফর নগর জেলার অন্তর্গত কান্ধলা নামক শহরে জন্মগ্রহন করেন। পরিবারেই তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। শৈশবেই পবিত্র কুরআনের হিফজ সম্পন্ন করেন।১৩২৬ হিজরীতে দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন । দেওবন্দে শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি রহ. এর কাছে তিনি সহি বুখারি শরিফ ও তিরমিজি শরিফ পড়েন।

শিক্ষাজীবন সমাপ্তের পর ১৩২৮ হিজরিতে মাওলানা ইলয়াস রহ. সাহারানপুর মাযাহিরুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৩৩০ হিজরি মোতাবেক ১৭ এপ্রিল ১৯১২ সালে তিনি মামা মৌলবি রওফুল হাসান সাহেবের কন্যাকে বিবাহ করেন। ১৩৩৩ হিজরিতে হজ পালন করেন। মেঝ ভাই ও বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি ভক্ত ও অনুরক্তদের অনুরোধে বস্তি নিযামুদ্দিনে অবস্থিত মসজিদ ও মাদ্রাসার সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর ১৯২০ সালে তিনি ভারতের মেওয়াত অঞ্চল থেকে তাবলিগি দাওয়াতের সূচনা করেন।

ছাত্রজীবনে তিনি রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ. এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। খলিল আহমদ সাহরানপুরি রহ. এর সাথে ইসলাহি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার বিশেষ তত্ত্বাবধানে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা সাধন করেন ও খিলাফত লাভ করেন।

সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ইসলামি নীতি ও আদর্শের ঘাটতিজনিত কারণে তিনি ১৯২০ এর দশকে তাবলিগ জামাত নামক সংস্কারবাদি আন্দোলনের সূচনা করেন। এই আন্দোলন ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধ প্রচার করে এবং মুসলিমদের নামাজ, রোজাসহ অন্যান্য ইবাদতের পদ্ধতি শিক্ষা দেয়ার কাজ করে। এর সদস্যদের কাজ স্বেচ্ছাসেবামূলক। সেই সাথে অন্যান্যদের এতে যোগ দিতে উৎসাহ দেয়া হয়। বিশৃংখলা দূরে রাখতে তাবলিগ জামাতে রাজনীতি ও ফিকহ নিয়ে আলোচনা করা হয় না। তিনি ১৯৪৪ সালের ১২ জুলাই ইন্তেকাল করেন।তার মৃত্যুর পর তার ছেলে শায়খ ইউসুফ কান্ধলভি তাবলিগ জামাতের আমির নিযুক্ত হন।

মাওলানা ইউসুফ কান্ধলবি রহ.
১৯১৭-১৯৬৫

শায়খ ইলিয়াস রহ. এর পর তাবলিগ জামাতের আমিরের পদে অধিষ্ঠিত হন শায়খ ইউসুফ কান্ধলবি রহ। তিনি শায়খ ইলিয়াস রহ. এর পুত্র। ২৫ জুমাদাল-উলা ১৩৩৫ হিজরি মোতাবেক ২০ মার্চ ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ রোজ বুধবার ভারতবর্ষের উত্তর প্রদেশের মুযাফফর নগর জেলার কান্ধলা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন।

১০ বছর বয়সে তিনি কুরআন এর হিফজ সম্পন্ন করেন। হেফজ সম্পন্ন করে বাবা শায়খ ইলিয়াস রহ এর কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।
শায়খ যাকারিয়া রহ. এর নিকট সুনানে আবু দাউদ পড়েন। মাজাহিরুল উলুম মাদরাসায় মাওলানা আব্দুল লতিফ রহ.এর কাছে সহি বুখারির পাঠ গ্রহণ করেন।

শিক্ষা সম্পন্ন করে তিনি আবু দাউদ শরিফ পাঠদানের মধ্যদিয়ে কর্ম জীবন শুরু করেন। তিনি বহু বছর আবু দাউদ শরিফ পাঠদান করেন। শায়খ ইলিয়াস রহ. এর মৃত্যুর পর তাবলিগের মুরব্বিরা তাঁর মাথায় আমিরের পাগড়ী পরিয়ে দেন। তখন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তাবলিগ ও দাওয়াতের মেহনতের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। কথিত আছে তিনি দিনে ১৮ ঘণ্টা নিজামুদ্দিনে বয়ান করতেন।

দিনব্যাপী তাবলিগের কাজে সময় ব্যয় করেও তিনি ফাঁকে ফাঁকে গ্রন্থ রচনা করতেন। বিশ্বজুড়ে মকবুল ও সমাদৃত তার তিনটি গ্রন্থ হল–
১. ‘আমানিল আহবার’-বিখ্যাত হাদিসের কিতাব শরহু মা’আনিল আছারের ভাষ্যগ্রন্থ ।২.‘হায়াতুস সাহাবা’ সাহাবিদের জীবনীগ্রন্থ
৩.‘মুন্তাখাব হাদিস’-তাবলিগ জামাতের ছয় নম্বর সম্পর্কিত নির্বাচিত হাদিসসমূহ, তার অনুবাদ ও ব্যাখ্যা সম্বলিত গ্রন্থ ।

শায়খ ইউসুফ কান্ধলবি জীবনের বেশিরভাগ সময় চিল্লায় কাটিয়েছেন। চিল্লায় পাকিস্তানে তিনি সফর করতেন বেশি। পাকিস্তানেই এক সফর অবস্থায় ২৯ জিলকদ ১৩৮৪ হিজরি মোতাবেক ২ এপ্রিল ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।

মাওলানা এনামুল হাসান রহ.
১৯১৮-১৯৯৫

তাবলিগি কাজকে বিশ্বব্যাপী করতে যারা আমরণ চেষ্টা করেছেন। যাদের শ্রমে তাবলিগ জামাত একটি সেবামূলক ধর্মীয় প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে । তাদের মধ্যে অন্যতম একজন মাওলানা এনামুল হাসান।

তিনি গোটা জীবনকে ইলমে অহির খেদমতের পাশাপাশি দীনি দাওয়াতের জন্য উৎসর্গ করেছেন। তিনি তাবলিগ জামাতের তৃতীয় মুরব্বি।
১৯১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের উত্তর প্রদেশের কান্ধালা নামক স্থানে তার জন্ম । বাবা মাওলানা ইকরামুল হাসান। বাবার কাছেই তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। তৎকালীন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হাফেজ মাংতুর কাছে পবিত্র কুরআনের হিফজ সমাপ্ত করেন।

মৌলভি হাকিম আব্দুল হামিদ বড়লভির কাছে উর্দূ ও ফার্সি ভাষাসহ হস্তাক্ষর সুন্দর করার বিদ্যা অর্জন করেন। আনুমানিক নয় কিংবা দশ বছর বয়সে তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মুরুব্বি মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর তত্ত্বাবধানে নিজামুদ্দিন চলে আসেন এবং মাওলানা ইলিয়াস ও মাওলানা এহতেশামুল হাসানের কাছে আরবি ভাষা-সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পাণ্ডিত্ব্য অর্জন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ের কিতাবদি অধ্যয়ন করার সময়ই শিক্ষক-মুরুব্বি মাওলানা ইলিয়াসের নজর কাড়েন এনামুল হাসান।

১৯৩৪ সালে সাহরানপুর মাজাহিরুল উলূম মাদরাসায় ভর্তি হন। এই মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার সুবাদে মাওলানা সিদ্দিক আহমদ কাশ্মিরি রহ. সহ দেশবরেণ্য বিভিন্ন আলিমদের কাছ থেকে ইলম অর্জন করার সুযোগ লাভ করেন মাওলানা এনামুল হাসান।

শাইখুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া কান্দলভির রহ. কাছে হাদিসের পাঠ গ্রহণ করার মাধমে ‘দাওয়ায়ে হাদিস’ জামাত সমাপ্ত করেন।
আধ্যাত্মিক সাধনার জগতেও মাওলানা ইলিয়াস ছিল তাঁর ওস্তাদ-পীর। ফারেগ হওয়ার পরপরই তাবলিগ জামাতের সময় ব্যয় করা শুরু করেছিলেন তিনি। মাওলানা ইলিয়াসের পরামর্শ মতো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে বা স্থানে জামাত নিয়ে সফরে যেতেন।তিনি নিজামুদ্দিনের কাশিফুল উলূম মাদরাসায় শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

১৯৬৫ সালে বিশ্বতাবলিগ জামাতের আমির মাওলানা ইউসুফ কান্দলুভির রহ. ইন্তেকালের পর শাইখুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া রহ. তাঁকে বিশ্বতাবলিগ জামাতের আমির হিসেবে মনোনীত করেন। ১৯৯৫ সালের ১০ জুন তিনি পরলোকগমন করেন।

মাওলানা যোবায়েরুল হাসান রহ.
১৯৫০-২০১৪

মাওলানা যোবায়েরুল হাসান রহ.। বিশ্ব তাবলিগ জামাতের অন্যতম নীতিনির্ধারক। ভারতের নিজামুদ্দীন মারকাজের শূরার অন্যতম শীর্ষ সদস্য। তাবলিগ জামাতের একক কোনো আমির না থাকলেও তাকেই শীর্ষ মুরবি্ব হিসেবে মানতেন সবাই। তার জন্ম ১৯৫০ সালের ৩০ মার্চ। প্রাথমিক পড়াশোনা বাবা মাওলানা এনামুল হাসানের কাছে সম্পন্ন করেন। জনাব আক্বসাদ রায়পুরি রহ.এর নিকট কুরআন শরিফ হিফজ সম্পন্ন করেন।১৯৭১ সালে ভারতের প্রখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামেয়া মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুর থেকে তিনি পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। কর্মজীবনে তিনি শিক্ষাদান ও দাওয়াতি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট শুক্রবার সর্বপ্রথম মাদ্রাসায়ে কাদিমের মসজিদে তাবলিগ জামাতের সঙ্গীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। এরপর থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত জড়িত ছিলেন নবীওয়ালা এই কাজের সঙ্গে। তাবলিগি কাজের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক লাইনেও কাজ করেছেন মাওলানা যোবায়েরুল হাসান (রহ.)।

পড়াশোনা শেষ করেই তিনি শায়খুল হাদিস জাকারিয়ার (রহ.) কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮ সালে তিনি খেলাফত লাভ করেন। বাংলাদেশের মুসলমানদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক ছিল মাওলানা যোবায়েরুল হাসানের। প্রতি বছর টঙ্গীর তুরাগ তীরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমায় তিনি নিয়মিত আসতেন। ইজতেমার বিশেষ আকর্ষণ আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করতেন তিনি। মোনাজাতের আগে তাবলিগের ছয় উসুলের ওপর হেদায়াতি বয়ানও করতেন তিনি। তার দরাজ কণ্ঠ, আবেগময় ভাষা এবং সাবলীল উপস্থাপনায় আখেরি মোনাজাত অন্য রকম এক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করত। তার দোয়ার কারণে হৃদয়ভেজা কান্না আর আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত হতো তুরাগতীর।

১৮ মার্চ ২০১৪ সালে রোজ মঙ্গলবার সকাল ১১টায় ড. রাম মানোহার লুহিয়া হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর।

 

Share This