মায়ানমারে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে, সমস্যায় সেনাবিহিনী

মায়ানমারে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে, সমস্যায় সেনাবিহিনী

রোজলিন ডি’‌কস্টা June 11, 2022

মায়নমারে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে। সেখানে নতুন শহর গড়তে যে বিনিয়োগ হয়েছে, তারই আড়ালে অর্থ বিনিয়োগ করেছে এই অপরাধ জগৎ। গড়ে তুলছে ক্যাসিনো। মায়ানমার সেনার বিরুদ্ধে লড়তে অর্থ, অস্ত্রের জোগান দিচ্ছে সেখানার আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে। ফলে মায়ানমার সেনার সঙ্গে আঞ্চলিক সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্ঘর্ষ বাড়ছে। কার্যত স্থবির হয়েছে শান্তি চুক্তি। নানান ধরণের অপরাধের পাশাপাশি মায়ানমারে বেড়ে চলেছে জুয়া, মুদ্রা পাচার, ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসাও।

এর নেপথ্যে রয়েছে ম্যাকাওয়ের কুখ্যাত মাফিয়া ওয়াং কুওক কুই। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার অন্ধকার জগতে তার পরিচিতি ‘‌ব্রোকেন টুথ কুই’‌ নামে। আন্তর্জাতিক এই মাফিয়া চক্রে রয়েছে ১৪ লাখ মাফিয়া এবং ৬ হাজর দুষ্কৃতী চক্র। এদের শাখা–প্রশাখা ছড়িয়ে রয়েছে আমেরিকা–সহ একাধিক দেশে। মূলত বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা চিনা নাগরিকদের ব্যবহার করে এরা চক্র চালাচ্ছে। হেরোইন থেকে শুরু করে আদম পাচার, চাঁদাবাজি, বেআইনি জুয়া চক্র চালানোয় এরা সিদ্ধহস্ত। সম্প্রতি কম্বোডিয়ায় আদম শরীরের অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ পাচারের পেছনেও এই গোষ্ঠীর যোগ পাওয়া গেছে। একটি খুনের ঘটনায় ১৩ বছর জেলে থাকার পর ২০১২ সালে মুক্ত হয়ে ওয়াং কম্বোডিয়ায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসা গড়ে তোলে। অপরাধ সাম্রাজ্য বিস্তারে নিজস্ব ক্রিপ্টো কারেন্সি ‘‌ট্রায়াড কয়েন’‌ বাজারে এনেছে। ওয়াং এখন ডংমেই গ্রুপ–এর প্রধান।

মায়ানমারের কেরানের ইয়েতাই শহরে ‘‌শোয়েকোকো’‌ প্রকল্প হচ্ছে। মোট তিনটি প্রকল্পে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে। যা ১০ গুন লাভজনক হয়ে উঠবে ২০২৭ সাল নাগাদ। এই সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থানীয় কিছু সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তা নিচ্ছে সংস্থাগুলি। সংস্থাগুলির দাবি তারা বেজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (‌বিআরআই)‌–র সঙ্গে যুক্ত এবং তাদের চিন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে যোগ রয়েছে।

হংকংয়ে নথিবদ্ধ ইয়েতাই ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং গ্রুপের সঙ্গে কেরান বর্ডার গার্ড ফোর্সের ২০১৭ সালে ইয়েতাই নিউ সিটি প্রজেক্ট গড়তে চুক্তি হয়েছিল। পেছনে ছিল মায়ানমারের জাতীয় সশস্ত্র বাহিনী। ইয়েতাই ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং গ্রুপের আন্তর্জাতিক বানিজ্য শৃঙ্খল রয়েছে। শোয়েকোকো শহরে ক্যাসিনো চালানোর অনুমোদন রয়েছে।‌ এই বিনিয়োগ বেসরকারি চিনা সংস্থার বলা হলেও এর মধ্যে অপরাধ জগতের টাকা রয়েছে। 

পাশাপাশি কেরানে হচ্ছে হনইয়া ইন্টারন্যাশনাল সিটি প্রজেক্ট। কেরান ন্যাশনাল ইউনিয়নের এগজিকিউটিভ কমিটির সদস্য এবং কেএনইউ সেনা দপ্তরের প্রধান রজার কিন এর সঙ্গে জড়িত। এই প্রকল্পে চিনা বেসরকারি সংস্থার বিনিয়োগ থাকলেও কেএনইউ এই প্রকল্পের অনুমোদন দেয় নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন কিছু বিনিয়োগকারীর অপরাধ জগতের যোগ থাকাটা কেএনইউ–র পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় শোয়েকোকো প্রকল্পর মূল বিনিয়োগকারী ওই শহরটিকে ইতিমধ্যেই নিজের বলে দাবি করছেন এবং মায়ানমার সরকারকে এড়িয়ে চলছেন।

 

বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের- 

 

মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। বেআইনি জুয়া এবং তার কারণে তৈরি হওয়া সম্পদ কম্বোডিয়ার শিহানুকভিলের বাসিন্দাদের শহরের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেখানকার বাসিন্দাদের ঠেলে দিয়েছে চিনা সংস্কৃতির দিকে। সেখানে কাজ পাওয়ার চাবিকাঠি চিনা ভাষা জ্ঞান। সেখানকার ক্যাসিনোগুলি আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় পুলিশ এবং নাগরিকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এভাবে কম্বোডিয়ার আর্থিক স্থিতি ভেঙে পড়ে এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক সহযোগিতা হারিয়েছে। 

মায়ানমারের কেএনএলএ–র সেনা বিভাগ কেরান ন্যাশনাল ইউনিয়ন (‌কেএনইউ)‌ সঙ্গে মায়ানমার সেনার বিরোধ সেই ১৯৪৯ সাল থেকে। কেএনএলএ–র খ্রীষ্টান ধর্মবলম্বীরা আলাদা সংগঠন গড়েছে। ১৯৯৪ সালে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা গড়ে তুলেছে ডেমোক্রেটিক কেরান বুদ্ধিষ্ট আর্মি (‌ডিকেবিএ)‌। ২০০৯ সালে মায়ানমার সেনা জাতিগত সশস্ত্র বাহিনীগুলিকে একটি বর্ডার গার্ড ফোর্সে অন্তর্ভূক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই বাহিনীগুলি নিজেদের এলাকার উন্নয়নের দায়িত্ব দেওয়ার কথাও ভাবা হয়। ডিকেবিএ–র একটি অংশ জেনারেল স চিট থু–এর নেতৃত্বে কেরান বর্ডার গার্ডের অন্তর্ভূক্ত হয়। উল্লেখ্য, এই স চিট থু–র বাহিনী অতীতে কেরান এবং মন প্রদেশে জাতিগত সশস্ত্র বাহিনীগুলির ওপর হামলা সংগঠিত করেছিল।

২০১৫ সালে কেরান ন্যাশনাল ইউনিয়ন মায়ানমার সরকারের সঙ্গে অস্ত্রবিরতি চুক্তি করে। যদিও এখন সেই শান্তি চুক্তি স্থবির হয়ে গেছে। কেএনএ–র নেতারা এখন স্বায়ত্ত্ব শাসনের জন্য ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছে। তাদের সঙ্গে মায়ানমার সেনা এবং বর্ডার গার্ড ফোর্সের মাঝেমধ্যেই সঙ্ঘাতের ঘটনা ঘটছে।

বিচ্ছিন্নতাবাদিদের গ্রেপ্তারির প্রতিবাদে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কেরান প্রদেশের লে কে কাও নতুন শহরের কাছে মায়ানমার সেনা এবং কেএনএলএ–র সঙ্ঘর্ষ হয়। দেখা যাচ্ছে ২০২১ সালের জুন মাসের পর থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি কেএনএলএ–র মায়ানমারের সেনাদের ওপর হামলা বাড়িয়েছে। ইতিমধ্যে সেখানে ২৬ জন সেনার মৃত্যু হয়েছে। জখম হয়েছেন ৩৫ জন। ওই বছরের জুলাইয়ের ১৫ থেকে ২২ তারিখের মধ্যে কেরান প্রদেশে ২৯টি এরকম হামলার ঘটনা ঘটেছে।

মনে রাখতে হবে মায়ানমারে যে সব চিনা বিনিয়োগ হয়েছে সেগুলির বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই সেদেশের সরকারের বিনিয়োগ কমিশনের অনুমোদন নেই। অভিযোগ উঠছে মায়ানমারকে পরিকল্পিত ভাবে মাফিয়াদের কলোনীতে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। জনসমক্ষে বেসরকারি বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলি বলছে তারা চিনের ডিআরআই–র ছত্রছায়ায় রয়েছে। এভাবেই সংস্থাগুলি সংস্থাগুলি চিন সরকারকে মায়ানমার এবং অন্যত্র খাটো করছে। বিআরআই–র দিকে অভিযোগ তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, চিনের কিছু আধিকারিক এভাবে হয় তো ভারত মহাসাগের উপকূলে মায়ানমারে স্থায়ী জটিল অপরাধ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। মায়ানমার সেনা তাতমাদ–র সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য কেরান ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (‌কেএনএলএ)‌ এবং আরও কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি অস্ত্র, অর্থ জোগাচ্ছে পিপলস লিবারেশন আর্মি।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত মায়ানমারেও কোভিড কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এই সুযোগে সেখানে বিনিয়োগ করতে আসা বেসরকারি চিনা সংস্থাগুলি অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ক্যাসিনো, আবাসন গড়ে তুলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া মায়ানমার সরকার এধরণের বেআইনি বিনিয়োগ ঠেকাতে পারবে না। আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের সহায়তায় কেরানের সশস্ত্র বাহিনীগুলি আরও শক্তিশালি হলে স্বায়ত্ব শাসনের দাবি তুলবে। এমনটাও হতে পারে স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার পাওয়ার পর সেই রাজ্যটি সম্পূর্ণ বিদেশি মালিকানায় চলে যাবে। কারণ তাদের আর্থিক নিয়ন্ত্রণ থাকছে বিদেশি সংস্থার হাতে। তখন কিন্তু নতুন ধরণের মতভেদ এবং সঙ্ঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হবে। মায়ানমার হয়ে উঠবে ভঙ্গুর একটি দেশ। তখন এক দেশ, দুই প্রশাসন পরিস্থিতি তৈরি হবে। সেই আঁচ আসবে বাংলাদেশের ওপরেও।‌ রোহিঙ্গা পরিস্থিতি যেমন জটিল আকার ধারণ করেছে, সেই রকমই বাংলাদেশের জন্য নতুন সমস্যা হয়ে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের নিয়ন্ত্রণে মাদক, আদম অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চক্র।‌ নতুন পরিস্থিতির কারণে যদি নতুন করে মায়ানমারের বাসিন্দারা বাংলাদেশমুখী হতে শুরু করেন তা আরও কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করবে।

Share This