রাজধারীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত বনানীতে গড়ে ওঠেছে বেশকিছু সীসা লাউঞ্জ। তথ্যমতে, নগরীর শুধু বনানীতেই রয়েছে ১৭টিরও বেশি সীসা লাউঞ্জ। এসব লাউঞ্জে রাত হলেই নেমে আসে পুরো শহরের তরুণ-তরুণীদের আনাগোনা ও আড্ডা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব লাউঞ্জের বেশিরভাগগুলোতে সীসার আড়ালে চলে উদ্যম ডিজে পার্টিসহ মাদক সেবনের কার্যক্রম। এমনকি কোনো কোনো লাউঞ্জে মদ বিক্রি করার পারমিশন না থাকলেও তা হচ্ছে খুব গোপনে। এগুলোতে গোপন কিছু রুম (যেগুলোতে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই) রয়েছে যেখানে ছেলে-মেয়ে মদ-সীসা গ্রহণ করছেন এবং একান্ত মূহূর্ত কাটাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, এগুলো সবই সম্ভব হচ্ছে লাউঞ্জগুলোর মালিকদের তত্বাবধানে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই মোটা অংকের এসব ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক লাউঞ্জের ম্যানেজার গণমাধ্যমকে বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা এসব দেখেও দেখছেন না। অভিযোগ রয়েছে, তারা লাউঞ্জগুলো থেকে অনৈতিক সুবিধা পেয়ে থাকেন বলেই বেশিরভাগ সময় চুপচাপ থাকেন। ফলে লোক দেখানো অভিযান করলেও তা আসলে কার্যত কিছুই নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোনো কোনো লাউঞ্জ প্রশানকে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন বলে তারা সারা রাত পর্যন্ত এগুলো খোলা রাখতে পারেন।
বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, কোনো কোনো লাউঞ্জ-রেস্টুরেন্ট রাত সাড়ে এগারোটা-বারোটার মধ্যে বন্ধ করার নিয়ম থাকলেও কোনোটি আবার ভোর রাত ও সকাল ৬টা- ৭টা পযর্ন্তও খোলা রাখে।
বনানীর ১১ নাম্বার রোডে অবস্থিত ‘এরাবিয়ান কোজি’ এমনি একটি লাউঞ্জ। জানা গেছে, এই লাউঞ্জটির মালিক পক্ষ থেকে প্রশাসনকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে বলে এটির অনিয়ম কারও চোখে পড়ে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এটির মালিক মো. নিলয় জামান পতিত সরকারের একজন সুবিধা পাওয়া নেতার সহযোগী ছিলেন। নিজেকে সবসময় প্রভাবশালী হিসেবে নানাভাবে পরিচয় দেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিজেকে যুবলীগের কর্মী বললেও এখন আবার রূপ পাল্টে নানা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে চলাফেরা করছেন এবং তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন।
সূত্র জানায়, নিলয় বনানী কড়াইল বস্তিতে থাকা একদল কিশোরগ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। শুধু তাই নয় ওইসব কিশোল গ্যাংকে তার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। কারও সঙ্গে ব্যবসায়ী দ্বন্দ্ব কিংবা বোঝাপোড়া না হলেই কিশোরগ্যাংদের দিয়ে হুমকিসহ আতঙ্ক ছড়ান।
এদিকে এই প্রতিবেদকের কাছে আসা তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধ ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্রদেরকে হত্যাচেষ্টার একটি মামলায় নিলয়ের নাম রয়েছে। সাভার থানায় করা সেই মামলার প্রধান আসামী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিলয় ওই মামলার ৭১তম আসামী। মামলার বাদী বাংলাদেশ পরিবেশ পরিক্রমা মানবাধিকার সাংবাদিক সোসাইটির ভাইস চেয়ারম্যান মো. তোহা।
জানা যায়, এই নিলয় মূলত ‘এরাবিয়ান কোজিতে সীসা ব্যবসার আড়ালে অবৈধভাবে আনা বিদেশী মদও বিক্রি করে থাকেন। লাউঞ্জে থাকা ছোট ছোট ‘প্রাইভেট’ রুমে আগত অতিথিদের তরুণী দিয়ে থাকেন বলে জানা গেছে। এসব রুম ঘণ্টায় ৩/৪ হাজার টাকা ভাড়া দেওয়া হয় বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন। নিলয় তার বাসা রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাতেও (জে ব্লক) মদ ও মাদকের আসর বসিয়ে থাকেন বলে জানা যায়।
গোপন তথ্যে আরওজানা গেছে, নিলয় আসছে থর্টিফাস্ট নাইটেও ‘এরাবিয়ান কোজি’তে ডিজে পার্টিসহ নানা আয়োজন করেছে। এই আয়োজনের জন্য ইতোমধ্যে অনেক মদ তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বাসায় মজুদ করা হয়েছে বলে জানা যায়।
এই লাউঞ্জের আরেক পার্টনার সোলেয়মান হাসান রনি। যিনি হবিগঞ্জের ছাত্রলীগের সদস্য এবং পতিত স্বৈরাচার সরকারের এমপি ব্যরিস্টার সুমন (হবিগঞ্জ-৪) তার ভগ্নিপতি বলে জানা যায়। এই রনি নিলয়ের সকল কাজের পার্টনার বলে বিশ্বস্ত একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিশ্বস্ত সূত্রটি আরও জানায়, ইংরেজী নববর্ষকে ঘিরে ‘নিলয় গং’ রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে দেশসেরা এক ডিজেকে নিয়ে বড় এক পার্টির আয়োজনের সকল প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছেন। এই আয়োজনকে ঘিরে অবৈধভাবে আনা লাখ লাখ টাকার বিদেশী মদের পাশাপাশি রয়েছে মাদকও।
নিলয় শুধু মদ-সীসার বাণিজ্যই করেন না। তিনি এসব ব্যবসার আড়ালে সমাজের উপরতলার মানুষদের নারী সাপ্লাই করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। সে তার লাউঞ্জে অনেক মানুষকে মেয়ে প্রোভাইড করে গোপন ক্যামেরায় তা ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ঘটনার বিষয়ে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।
সীসা লাউঞ্জের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ নিয়ে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রাসেল সারোয়ার- এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোনে কথা বলবেন না বলে জানান (এই সংক্রান্ত একটি ফোন রেকর্ড আছে)। তাকে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিতে বলেন। তার ব্যবহৃত নাম্বারে কয়েকবার হোয়াটসঅ্যাপে কল দিলেও তা রিং হয়নি এবং পরবর্তীতে ফোনে কল দিলেও তা তিনি রিসিভ করেননি।
এদিকে এসব অভিযোগের বিষয়ে নিলয় জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর কথা বলেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বনানীতে ‘এরাবিয়ান কোজি’ ছাড়া এমন কয়েকটি লাউঞ্জের মধ্যে রয়েছে সিলবার, মারবেলা, থার্টি টু ডিগ্রী, ব্লাকবিজ, সেলো উল্লেখযোগ্য।
এদিকে এসব সীসা লাউঞ্জের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যেই কিছু অভিযান পরিচালনা করে থাকেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে বনানীর তিনটি সীসা লাউঞ্জে অভিযান চালিয়ে চারজনকে আটক করেছে ডিএনসি। অভিযানে লাউঞ্জগুলো থেকে ৯ কেজি সীসা জব্দ করা হয় বলে জানা গেছে।
সেসময় ডিএনসির ঢাকা মেট্রো কার্যালয়ের (উত্তর) উপপরিচালক শামীম আহম্মেদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল, অভিযানে আল গ্রিসিনো সীসা লাউঞ্জ থেকে ৫ কেজি ২০৪ গ্রাম, এরাবিয়ান কোজি সীসা লাউঞ্জ থেকে ৩ কেজি ৪০০ গ্রাম এবং সেলসিয়াস সীসা লাউঞ্জ থেকে ২১৮ গ্রাম সীসা ও সীসা তৈরির উপকরণ ও সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়। এসময় এসব কাজে সংশ্লিষ্ট চার ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে বলেও তখন জানান শামীম আহম্মেদ।
তবে দু:খজনক হলেও সত্যি অভিযানের পর অদৃশ্যভাবে আরও দ্বিগুণ শক্তি রূপে প্রতিষ্ঠানগুলো ফিরে আসে। তারা ব্যবসা চালিয়ে যায় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি রয়টার্সের এক সংবাদ অনুযায়ী একটা পুর্ণ সেশনের সীসা গ্রহণ বা এক প্যাকেট সিগারেট সেবনের মতোই মারাত্মক। ক্ষতির দিক দিয়ে সীসা বা সিগারেট দুটো জিনিসই ক্ষতিকর। সিগারেটে যেখানে ১-৩% নিকোটিন থাকে, সেখানে সীসাতে ব্যাবহৃত তামাক থেকে ২-৪% নিকোটিন উৎপাদন হয়ে থাকে (ড. কেনেথ, আমেরিকা একাডেমী অফ পেডিয়াট্রিক্স এর প্রেসিডেন্ট)।
২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮’ কার্যকর হয়েছে। ওই নতুন আইনে সীসাকে মাদকদ্রব্যের ‘খ’ শ্রেণির তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নতুন আইনে মাদক সম্পর্কিত অপরাধ প্রমাণিত হলে ন্যূনতম এক বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড ও নগদ অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ীরা আইনের তোয়াক্কা করছে না। তারা নানা কৌশলে নিষিদ্ধ সীসা কেনাবেচা অব্যাহত রেখেছে।