মানবাধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সহায়তার লক্ষ্যে বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের মিশন চালু হতে যাচ্ছে। তিন বছর মেয়াদি মিশন চালুর জন্য দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম এতে সই করেন।
জেনেভা থেকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর গতকাল শুক্রবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়। ‘এই সপ্তাহে’ সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ রয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত বছরের আগস্ট থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের সম্পৃক্ততা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। পরিষদটি মানবাধিকার সংস্কারে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে কাজ করছে এবং গণবিক্ষোভ দমনের নামে সংঘটিত প্রাণঘাতী দমনপীড়নের বিষয়ে একটি বিস্তৃত তথ্য-অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, ‘এই সমঝোতা স্মারক দেশটির মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়, যা একটি রূপান্তরের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। এটি আমার দপ্তরকে আমাদের তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে প্রদত্ত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে আরও কার্যকরভাবে সহায়তায় সক্ষম হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের চলমান মৌলিক সংস্কারগুলোতে সরকার, সুশীল সমাজ এবং অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে সরাসরি মাঠ পর্যায়ে যুক্ত হয়ে আমাদের দক্ষতা ও সহায়তা প্রদানের সুযোগ দেবে।’
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন এই মিশন বাংলাদেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিশ্রুতি পূরণের লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে। পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সক্ষমতা বাড়াতেও কাজ করবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘সমঝোতা স্মারক সই আনুষ্ঠানিকভাবে বসে হয়নি। আপাতত তিন বছরের জন্য এটি করা হয়েছে। পরে নবায়নের সুযোগ রয়েছে।
ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের বিক্ষোভ
ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার মিশন চালুর বিষয়ে হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং বিভিন্ন সংগঠন আপত্তি জানিয়ে আসছিল। সমঝোতা স্মারক বাতিলের দাবিতে গতকালও বিক্ষোভ করে ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।
জুমার নামাজ শেষে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর ফটকে দলটির ঢাকা মহানগর (উত্তর-দক্ষিণ) শাখা গোপালগঞ্জে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ এবং ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর খোলার অনুমতি বাতিলসহ কয়েক দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করে।
সমাবেশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব ইউনুস আহমদ বলেন, ‘কিছুদিন আগেও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, দেশে কোনো জঙ্গি নেই। যখন জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের অনুমতি হয়েছে, তখনই দেশে নতুন করে জঙ্গি নাটকের অবতারণা হচ্ছে। যারা জঙ্গি নাটকের কলাকুশলী ও অভিনেতা, তাদের সবাইকে জাতির সামনে স্পষ্ট করতে হবে এবং কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি ইমতিয়াজ আলম মানবাধিকার দপ্তর স্থাপন প্রসঙ্গে বলেন, ‘ফিলিস্তিন, আফগানিস্তানসহ দেশে দেশে
মুসলিম নির্যাতনে কী ভূমিকা পালন করেছে? এখন এ দেশে মানবাধিকার দেখাতে চায়? বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় না। বাংলাদেশে হাজার বছরের ঐতিহ্য হলো, হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলিম সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস।’
গতকাল একই স্থানে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আয়োজনে জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার দাবিতে সমাবেশ হয়। সেখানে দলটির মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘যে কোনো মূল্যে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন থেকে সরকারকে সরে আসতে বাধ্য করা হবে।’
এর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। ১১ জুলাই সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি মামুনুল হক বলেন, ‘গত ১৬ বছরে ঘটে যাওয়া বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও খুনের বিচার নিশ্চিত না করে এখন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য দরজা খুলে দেওয়া মানে অপরাধীদের দায়মুক্তি ও জনগণের প্রতি অবিচার। খাল কেটে কুমির আনার অধিকার সরকারকে কেউ দেয়নি। এই মানবাধিকার কার্যালয় ঢাকায় প্রতিষ্ঠা হতে দেওয়া হবে না।’
স্বাগত জানালেন বিশিষ্টজন
বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার মিশন চালুর সমঝোতা স্মারক সইকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশিষ্টজন। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অনারারি নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন সমকালকে বলেন, ‘এটা সরকারের ভালো উদ্যোগ। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় থাকা দরকার আছে। তারা থাকলে বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো সরকারকে বলতে পারবে এবং সরকারও এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারবে।’
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘এটা সরকারের ভালো উদ্যোগ ও সমর্থনযোগ্য। তবে ইসলামী দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই অফিস স্থাপনের বিরোধিতা করছে। সে বিষয়টি কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, ভলকার তুর্ক বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যাপারে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেছেন। তিনি নিরপেক্ষ নন। এ কারণেই বিভিন্ন ইসলামী দল জাতিসংঘের অফিস স্থাপনের বিষয়ে বিরোধিতা করে আসছে। বিষয়টা সরকারের মাথায় রাখতে হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গুম কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ‘বাংলাদেশ যে মাত্রায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, তাতে ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন অফিস থাকা দরকার। এটা আমরা অনেক আগেই চেয়েছিলাম। জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় থেকে তদন্ত দল ঢাকায় পাঠাতে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু বিগত সরকার তাদের অনুমোদন দেয়নি। এখন এটা হলে মানবাধিকার আন্দোলন আরও জোরদার হবে। সেই সঙ্গে জনগণের মানবাধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’